গল্প- রং- বেরং

রং- বেরং
-মুনমুন রাহা

 

আকাশ জুড়ে রংয়ের মেলা। কোথাও ধূসর কোথাও বেগুনি আবার কোথাও এখনো লালচে আভা। সারাদিনের পরিশ্রমের পর বিদায় নিচ্ছেন সূর্য দেব । এই ক্লান্ত জৌলুসহীন সূর্যকে আর দরকার নেই পৃথিবীর। যতক্ষন পর্যন্ত তার তেজ ছিল , পরিশ্রমের ক্ষমতা ছিল ততক্ষন সে ছিল ভারী অমূল্য , ভারী প্রয়োজনের। আজ সে নিজের শক্তির সাথে নিজের প্রয়োজনীয়তাও হারিয়েছে। ঠিক সুচিত্রা দেবীর মতো ।

নিজের ঘরের বড় জানলাটার সামনে রাখা চেয়ারে বসে অস্তাচল সূর্যের দিকে তাকিয়ে এ কথাই ভাবছিলেন সুচিত্রা দেবী। আজকাল তার জীবনটাকে বোঝা মনে হয়। যত বার্ধক্য ঘিরে ধরছে ততই যেন পুরোন দিনের কথা গুলো বেশি বেশি মনে পড়ছে। আগে যে সংসারের ঊন কোটি চৌষট্টীটা কাজ তাকে ছাড়া হতো না সে সংসারের এখন সব কিছুই তাকে ছাড়াই হয় । নাঃ , অমর্যাদা নেই তার এই সংসারে । ছেলে , বৌ , নাতি বা সদ্য আসা নাত বৌ সবাই সম্মান করে । কিন্ত সব কিছুতেই যেন তিনি ব্রাত্য। কোন কিছু রান্না করতে গেলে বৌমা রে রে করে ওঠে , ঝাঁজ লেগে এখনই কাশি উঠবে বলে , বড়ি দেওয়া , সেলাই করাও বন্ধ হয়ে গেছে । চোখের অপারেশন আর কোমরের অপারেশনের পর ছেলের স্ট্রিকলি নির্দেশ তিনি যেন এসব কাজ না করেন। তবে সত্যি কথা আরও একটা আছে , কেবল সবাই বকাবকি করেন বলে যে তিনি এসব কাজ থেকে বিরতি নিয়েছেন তা নয় , তিনি নিজেও বুঝতে পারেন তিনি আর আগের মতো পারেন না , কষ্ট হয় বড়। তাই মেনেই নিয়েছেন সব কিছু।

এই যে কদিন আগে নাতির বিয়ে হল , তাতে কোন কাজে লাগলেন তিনি ? কেবল নাত বৌ বাড়ি আসার পর আশীর্বাদ করা ছাড়া! অথচ বিয়ে বাড়িতে কত কাজ , তার কাছে এসব কাজ এককালে নস্যি ছিল। আজ ইচ্ছা থাকলেও ক্ষমতার অভাব! আজকাল আর কিছুই ভাল লাগে না । খেতেও ইচ্ছা করে না , নানা রোগে ঘুম তো কবেই ছেড়ে গেছে। রাতে খুব জোর ঘন্টা দুই তিন ঘুমান । আজকাল মনে হয় এই বিশ্ব সংসারে তিনিই কর্মহীন। অন্তহীন সময় তাকে গ্রাস করতে আসে। তিনি যেন একটা ভার হয়ে বসে আছেন এই পৃথিবী বক্ষে। তার একমাত্র কাজ মুক্তির অপেক্ষা। এসব ভাবতে ভাবতে দুচোখ দিয়ে কখন যেন বারিধারা নেমে এসেছে । তিনি ক্লান্ত মনটাকে একটু আরাম দিতেই চোখ বুঝলেন।

সুচিত্রা দেবীর নাত বৌ পরমা এসে থেকেই দেখছে তার দিদি শাশুড়ি তেমন ভাবে কথা বলেন না , খান না । গল্প করা , হাসি আনন্দ এসবের যেন তার জীবনে কোন অস্তিত্বই নেই। আজ সুযোগ বুঝে তার বর মানে সুচিত্রা দেবীর নাতি রক্তিমকে জিজ্ঞেস করল,

” আচ্ছা আমি এসে থেকেই দেখছি তোমার ঠাম্মা ভারী রিজার্ভ। তাই না! আমি যে এত হাহা হিহি করে বেরাই সারাদিন তোমাদের বাড়িতে উনি কি তাতে রাগ করেন গো! মানে তেমন ভাবে তো কথাই বলেন না , তাই ঠিক বুঝতেও পারি না। “

রক্তিম নতুন বৌকে একটু কাছে টেনে বলল,

” তুমি আমার ঠাম্মাকে চেনোই নি। ভারী ভাল মানুষ। ছোটবেলায় কত মজার মজার গল্প বলতো জানো ! মা তো চাকরিতে যেত , আমাকে খাইয়ে দেওয়া , ঘুম পাড়ানো সব ঠাম্মা করত । এতকিছু করেও সুন্দর সুন্দর সেলাই করত, বড়ি আচার আরও কত কিছু বানাত। আর সব থেকে ভাল ছিল ঠাম্মার রান্না। রান্নার লোক থাকলেও আমি ছোটবেলায় ঠাম্মার হাতের রান্না ছাড়া খেতেই চাইতাম না! জানো ঠাম্মা একটা গলদা চিংড়ির মালাইকারি করত দা_রুণ । তারপর আস্তে আস্তে সব বদলে গেল। ঠাম্মার শরীর ভেঙে পড়ল। মা ঠাম্মার খেয়াল রাখতে চাকরি থেকে বিরতি নিল সংসারের হাল ধরল। আমিও পড়াশোনা , চাকরিতে ব্যাস্ত হয়ে পড়লাম। ঠাম্মাও আস্তে আস্তে কেমন যেন নিজের মধ্যে গুটিয়ে যেতে লাগল। এখন তো আরও চুপচাপ হয়ে গেছে। ভাল করে খাওয়া ঘুম কিছুই করে না । ডাক্তার তো বলছে ডিপ্রেসানের দিকে চলে যাচ্ছে । দেখা যাক কি হয়!
তবে এত কিছুর পরেও, আজও সেই গলদা চিংড়ির মালাইকারির জন্য মন কেমন করে । “

সুচিত্রা দেবী সবে স্নান সেরে উঠেছেন। পরমা গুটিগুটি পায়ে এল তার ঘরে ,

” আসব ?”
” কে ? “
এক ঝলক পরমা দেখে খানিক বিরক্ত হয়েই বললেন,

” কি ব্যাপার! তোমার আবার কি চাই? হঠাৎ আমার কাছে ?”

” কেন আসতে পারি না ?”

” আমার এত কথা ভাল লাগছে না ! কোন দরকার থাকলে বল ?”

” তোমার নাতি কাল তোমার গল্প করছিল! তোমার রান্নার গল্পও করল । শোনালো তোমার হাতের গলদা চিংড়ির মালাইকারির স্বাদের গল্প। ঠাম্মা , আমি এসব রান্না তেমন জানিনা । কিন্ত শিখতে চাই। শেখাবে আমাকে ?”

সুচিত্রা দেবী কিছুক্ষণ চুপচাপ তাকিয়ে রইলেন পরমার দিকে। তারপর বলেন,

” রতির এখনও মনে আছে আমার রান্নার কথা !”

” হ্যাঁ গো। শুধু মনে নয়, প্রাণে জিভে সবেতেই আছে । শেখাবে গো আমাকে ?”

” বলছ রান্না জানো না ? কিন্ত তোমার শাশুড়ি মা যে বলেছিলেন, তুমি নাকি খুব ভাল রান্না কর ! “

” করি তো । তবে ইন্ডিয়ান পারি না। আমি খুব ভাল চাইনিজ আর থাই করি ।”

সচিত্রা দেবী একটু থেমে বললেন,

” সেসব না হয় বুঝলাম, কিন্ত আমার তো আর সেই ক্ষমতা নেই যে তোমাকে রান্না করে শেখাব ! শরীর জানান দিচ্ছে এসব আর আমার জন্য নয়!”

” রান্না করতে হবে কেন ! তুমি বলবে আমি লিখে নেব , তারপর যখন রান্না করব তখন তুমি একটু করে চেখে দেখবে আর কি ভুল হয়েছে বলবে ,তাহলেই হবে।”

আজকাল সুচিত্রা দেবীর ভারী জ্বালা হয়েছে পরমাকে নিয়ে। সেই যে সেদিন মালাইকারি খেয়ে সবাই খুব প্রশংসা করল, সেই থেকেই মেয়েটা মাঝেমাঝেই চলে আসে সুচিত্রা দেবীর কাছে রান্নার রেসেপি জেনে নিতে । সত্যি বলতে কি সুচিত্রা দেবীরও বেশ ভালোই লেগেছিল যখন নাতি রক্তিম মালাইকারি খেয়ে সোজা হাজির হয়েছিল সুচিত্রা দেবীর ঘরে । সেই ছোট্ট বেলার মতো গলা জড়িয়ে বলেছিল,

” ঠাম্মা অনেকদিন পর আবার তোমার হাতের মতো রান্না খেলাম । তোমার তালিমে পরমা বেশ ভালোই রেঁধেছিল বল ! জানো কতবার ভেবেছি একবার বলি একদিন মালাইকারি করতে , কিন্ত ভয় হতো যদি আবদার সামলাতে গিয়ে তোমার শরীর খারাপ হয়!”

সুচিত্রা দেবীর ছেলে আনন্দ আর বৌমা শীলাও বেশ খুশি , রক্তিমের তো কথাই নেই । এখন ছুটির দিন হলেই সুচিত্রা দেবীর তালিম নিয়ে পরমা মাঝেমাঝেই সাবেকি রান্না করে । অবশ্য মাঝেমাঝে থাই বা চাইনিজও হয়। শীলা রোজকার রান্নাতে থাকে । দিন গুলো এগোতে থাকে । সুচিত্রা দেবী এখন আর দুঃখ বিলাসের খুব একটা সময় পাননা। পরমার জন্য রান্নার রেসিপি ভেবে রাখতে হয় যে !

শীত হাল্কা হাল্কা পরতে শুরু করেছে সবে । নিজের ঘরে দুপুর বেলা পানের ডিবেটা সবে বার করেছেন সুচিত্রা দেবী এমন সময় বাড়িতে হৈ হৈ শব্দ শুনে একটু থমকালেন। গলাটা যে পরমা আর রক্তিমের তাতে সন্দেহ নেই। কিন্ত কি এত চেঁচামেচি করছে কে জানে ! আজ ছুটির দিন হলেও দুজনের টিকির দেখা নেই সকাল থেকে। অবশ্য নতুন বিয়ে এটাই তো সময় একে অপরের হাতে হাত রেখে ঘোরার! এসব ভাবনার মাঝেই পরমা , রক্তিম, শীলা, আনন্দ সবাই হৈ হৈ করে ঢুকে পড়েছে সুচিত্রা দেবীর ঘরে । আনন্দ এসে মাকে জড়িয়ে ধরে বলে ,

” দেখ তোমার নাত বৌ কি করেছে! “

পরমা এগিয়ে এসে সুচিত্রা দেবীর হাতে তুলে দেয় একটা বই । কিছু না বুঝতে পেরে সুচিত্রা দেবী চোখে চশমা এঁটে দেখেন বইয়ের মলাটে বড় অক্ষরে লেখা ” সাবেকি রান্নার সম্ভার ” লেখিকা , সুচিত্রা স্যানাল। খান চারেক বার নিজের নামটা পড়লেন সুচিত্রা দেবী , তারপর ভেজা দুচোখে পরমাকে বললেন,

” এসব সত্যি! আমার রান্নার রেসিপির বই ! এসব করলি কখন! “

” কেন মনে নেই তোমার থেকে রেসেপি জেনে একটা খাতায় লিখতাম! কেমন লাগছে বল ! রাইটার সুচিত্রা স্যানাল!”

রক্তিম বলে ,

” উঁ হুঁ , ওসব চোখের জলটলে কিচ্ছু হবে না । ট্রিট চাই ব্যাস! আজই অর্ডার করব মন যা চায়, পেমেন্ট কিন্ত তুমি করবে ঠাম্মা। “

সুচিত্রা দেবী তখনও তাকিয়ে আছেন পরমার দিকে , বললেন,

” জানিস আমার মনে হত আমার বুঝি সব কাজ শেষ হয়ে গেছে এই পৃথিবীতে । কিন্ত তোর জন্য আবার একটা কাজ খুঁজে পেয়েছিলাম! যাক শেষ জীবনে নিজের নামটা তো বইয়ের পাতায় দেখতে পেলাম তোর জন্য। আমার আর কিছু দরকার নেই রে ! “

পরমা এবার সুচিত্রা দেবীর কাছে গিয়ে বলে ,

” ঠাম্মা এতবড় পৃথিবীর মাঝে আমাদের এইটুকু জীবনে সব কাজ ফুরানো এত সহজ নয়। কেবল কাজের দিক পরিবর্তনের দরকার হয় সময় মতো । বই লেখার কাজ শেষ তো কি ! আমি প্ল্যান করেছি আমরা , মানে আমি আর তুমি একটা রান্নার স্কুল খুলব। আমি থাই আর চাইনিজ শেখাব আর তুমি সাবেকি রান্না । অবশ্য আমি তোমার হেল্পারও হব। বয়স হলেই সব কিছু ফুরিয়ে যায় না ! পুরোন কে পিছনে ফেলে নতুনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার নামই তো জীবন! আর তাছাড়াও ঠাম্মা ইউ আর আ স্টার। ঠিক সূর্যের মতো।”

সুচিত্রা দেবী এতক্ষন অবাক হয়ে পরমার কথা শুনছিলেন এবার বললেন,

” আমিও নিজেকে সূর্যের সাথে তুলনা করি জানিস ! অস্তচলে যাওয়া সূর্যের মতো যার সব কাজ শেষ , যার প্রয়োজন ফুরিয়ে গেছে , যার তেজ শেষ হয়ে গেছে , তেমন সূর্য আমি ! “

পরমা হেসে বলে ,

” তোমার তো কনসেপ্টটাই ভুল। যার নিজস্ব আলো আছে তার তেজ কি ফুরায়? না তার প্রয়োজন কখনও কমে। আসলে সূর্য তো অস্ত যায় না , পৃথিবীর একদিকে আলো দেওয়া হয়ে গেলে সে চলে অন্যদিক আলোকিত করতে । দিক পরিবর্তন। তুমিও তেমন। সংসারের জন্য তুমি অনেক কাজ করেছ এককালে গায়ে গতরে। এখন অন্য ভাবে পরিশ্রম কর । যা তোমার শরীরে সহ্য হয়। অন্যভাবে আলোকিত কর আমাদের। আমাদের জীবনের রং আমরাই ঠিক করি । আমরা চইলে তা রঙিন আর না চাইলে তা বেরঙিন । শরীর বয়স তো আটকানো যাবে না তাই সে বাড়ুক নিজের মতো কেবল লক্ষ্য রাখবে মনের বয়স যেন না বাড়ে। ব্যাস , তাহলেই তুমি ইয়ং। বুঝলে ডারলিং!”

সুচিত্রা দেবী কপট রাগ দেখিয়ে বললেন,

” মেয়ের সাহস তো কম নয় দিদি শাশুড়ির সাথে মশকরা হচ্ছে!”

রক্তিম আবার ফুট কাটে ,

” আমার প্রস্তাবের কি হল ?”

সুচিত্রা দেবী এবার আদেশের সুরে বলেন,

” তোমার প্রস্তাব ক্যানসেল করা হল । পরমা , খাতা নিয়ে আয় আজ রাতের মেনুর রেসিপিটা লিখে নে , বাসমতি পোলাও আর নবাবী মটন। “

Loading

Leave A Comment